Monday, April 29, 2024 | Journalism Without Fear or Favour

বিখ্যাত লেখিকা তানিয়া পারভীন তামান্নার আলোচিত উপন্যাস "ডিভোর্স"

Thu Sep 22, 2022 02:46 PM | Last update on: Mon Apr 29, 2024 02:06 AM

বিখ্যাত লেখিকা তানিয়া পারভীন তামান্নার আলোচিত উপন্যাস "ডিভোর্স"

ডিভোর্স

তানিয়া পারভীন তামান্না 

 

মূলত আমার মৃত্যু হয়ে গিয়েছিলো মিঃ ফারদিন। 

আমাদের কবুলের আগের দিন সন্ধ্যায় নিপুণ আমাকে কল করেছিলো বড় আপার বাড়ির টিএনটি ফোনে। আমরা সব ভাইবোন, ভাবীরা, ভাস্তা-ভাস্তি, ভাগ্না-ভাগ্নি সহ সবাই তখন বড় আপার বাড়িতে। পরের দিন আমার বিয়ে। সবাই খুব আনন্দে মজে আছে। আমার মেঝো আপুর বিয়ের এগারো বছর পরে আমার বিয়ে। স্বভাবতই আমার সব ভাইবোনের মনে খুশির আমেজ বইছিলো। আমার মা এবং লাল ভাই প্রথমে রাজি না হলেও পরে আমার খুশিকে তারা মেনে নিয়েছিলেন। তো বাড়ির সবাই গল্প আড্ডায় মেতে আছেন। আত্মীয় স্বজনরা সবাই বিয়ের কার্ড পেয়ে গিয়েছিলেন। বিয়েতে সবাই আসবে। তো নিপুণ ফোনে আমার সাথে কথা বলছিলো। সারাদিন সে কি,কি করেছিলো, তাদের বাড়ির কে, কি করেছে, সবার মন্তব্য কি এই গুলো নিয়ে কথা হচ্ছিলো আমাদের মধ্যে। সে তার বাবা সম্পর্কে অনেক নেগেটিভ কথা বলছিলো। বিশেষ করে তার বাবা একটা নির্দিষ্ট অংকের টাকার কথা উল্লেখ করে নিপুণকে বলেছিলেন,"এই টাকার মধ্যেই সবকিছু হয়ে যাবে কিন্তু তিনি এই টাকার বাইরেও আরও অনেক কিছু বলে নিপুণের কাছ থেকে আরও টাকা চাইছিলেন এবং তার মেয়েদের,নাতি নাতনীদের জন্য আরও কিছু শপিং করতে বলেছিলেন"। এটাতে নিপুণ ভীষন বিরক্ত হয়েছিলো। কারণ বিয়েটা সম্পূর্ণ নিপুণের ধার করা টাকায় হচ্ছিলো। এই জন্য আমিও আমাদের বাড়ির কারো জন্য কোনো শাড়ি কিনতে দেইনি তাকে। এমন কি আমাকে জুয়েলারি পর্যন্ত দিতে মানা করেছিলাম কারণ জুয়েলারি কেনার মতো সাধ্য তখন তার ছিলো না। আর আমার কাছে গয়নার চেয়ে ভালেবাসার মানুষটার মূল্য অনেক বেশি। নিপূণ নিজেই তো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ গহনা ছিলো। তার মায়ের একটা নেকলেস জুয়েলারীতে বন্ধক রাখা ছিলো। সেটা ছাড়িয়ে এনে আমার হাতের মানতাসা আর মাথার টিকলি গড়িয়ে দিয়েছিলো। এক ভরি দশ আনা স্বর্ন ছিলো সেখানে। আর এনগেজমেন্টের সময় একটা ফিঙ্গার রিং দিয়েছিলো তিন আনা স্বর্ণের। এই তো সাড়ে এগারো বছরের সংসার জীবনে আমাকে দেয়া তার গয়নার হিসাব। দুই ভরি স্বর্ণও সে দেয়নি আমাকে। হা হা হা। 

তো নিপুণ আমাকে তার বাবা সম্পর্কে  অনেক নেগেটিভ কথা বলার এক পর্যায়ে আমি তার সাথে তাল মিলিয়ে বলেছিলাম,"তোমার বাবা তো একটা ভেজাল"। ব্যাস এটাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। নিপুণ হঠাৎ প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলো এবং আমাকে বলেছিলো,"কি বললা তুমি আমার আব্বা সম্পর্কে? আমি আগামীকালকে বরযাত্রী নিয়ে বিয়ে করতে আসবো না এবং এটাই আমার ফাইনাল সিদ্ধান্ত। পৃথিবীর এমন কোনো শক্তি নাই যে, আগামীকাল কে বিয়ের অনুষ্ঠানে আমাকে নিয়ে আসে"। মিঃ ফারদিন,বুঝতে পারছেন আপনি অবস্থা টা কতটা ভয়াবহ? কতবড় অপমান সে আমাকে আবারও করলো! একজন মানুষ সে তার কষ্টগুলো আমার সাথে শেয়ার করছে। আমিও তার ব্যথায় ব্যথিত হয়ে কথা বলছি। যখন আমি জানি,তার বাবা আমাদের বিয়েটা ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন বহুবার, যখন আমি জানি, তার বাবা আমাদের আকদটা না করিয়ে আমার বড় দুলাভাই আর লাল ভাই এর মধ্যে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তারা কেউ কাউকে সহ্য পর্যন্ত করতে পারতেন না দীর্ঘদিন। অনেক দিন পরে তাদের সেই ঝগড়াটা মিটেছিলো ঠিকই কিন্তু যিনি ঝগড়াটার কারণ, তিনি তো তাদের কাছে সারাজীবনের মতো খারাপ হয়ে গিয়েছিলেন। আর নিপুণের সাথে তার বাবার সম্পর্কটা যে খুব ভালো ছিলো তাও নয়। তাদের বাবা ছেলের সমপর্ক টা ছিলো দা কুড়ালের মতো। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারতো না। কারন তার বাবা চল্লিশ বছর বয়স থেকে সমস্ত ইনকাম ছেড়ে দিয়ে নিপূণের উপরে সংসারের দায়িত্ব চাপিয়ে নিজে অলস বসে থাকতেন আর নিপুণের সাথে টাকা নিয়ে খারাপ ব্যবহার করতেন। এই জন্য নিপূণ তার বাবার প্রতি ভীষন বিরক্ত ছিলো। আর আমার মনেও নিপুণের বাবার প্রতি একটু অভিমান তো ছিলই তারপর যখন নিপুণ নিজেই তার বাবা সম্পর্কে নেগেটিভ মন্তব্য করছিলো আমার কাছে তখন আমি একটা কথা বলতেই পারি। এটা জাষ্ট কথার পিঠে একটা কিছু বলতে হয় তাই বলা। আমিও বলেছিলাম। যদিও সেটা খারাপ কিছু ছিলো না। আর এটার জন্য নিপুণ বিয়েতে না আসার হুমকি দিবে, এটা কোনো কথা হতে পারে না মিঃ ফারদিন। তখনো পর্যন্ত বিয়েটা নিয়ে অনেক কিছু চলছিলো আমার মনের মধ্যে। তবুও তো শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করছিলাম আমি। নিপুণ আমার সাথে অনেক রাগারাগি,চেঁচামেচি করে পরের দিন বরযাত্রী নিয়ে বিয়ে করতে সে আসবে না বলে ঠাস করে ফোনটা রেখে দিয়েছিলো।

আমি তখন কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে ফোনের কাছেই বসে পড়েছিলাম। আর ভাবছিলাম পরের দিন যদি নিপুণ সত্যি সত্যিই না আসে তবে আমি হয়তো বেঁচে যাবো কিন্তু আমার বাড়ির লোকজন চরমভাবে অপমানিত হবেন। তারা অবর্ননীয় কষ্ট পাবেন এবং কতটা লজ্জিত হবেন সেটা প্রকাশের ভাষা আমার জানা নাই। মিঃ ফারদিন,আমি তখন সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না যে, আমার তখন ঠিক কি করা উচিত। এমন সময় ফোনটা আবারও ঝনঝন শব্দে বেজে উঠেছিলো। আমি ফোনের কাছেই ছিলাম তাই ফোনটা আমিই রিসিভ করেছিলাম। নিপুণ তখন আমাকে বলেছিলো, "তোমার সাথে আর কোনো কথা নয়, তোমার বড় আপাকে ফোনটা দাও। তার সাথে কথা আছে"। আমি নিপূণের সাথে বারবার কথা বলতে চাইছিলাম। আমি চাইছিলাম আমাদের মধ্যের সমস্যাটা আমরা নিজেরাই মিটিয়ে ফেলি কিন্তু সে আমার কোনো কথা-ই শুনতে চাইলো না। তাই আর কথা না বাড়িয়ে বড় আপা কে ফোনটা দিয়ে দিলাম। সে এই প্রথম আমার নামে কমপ্লিন করলো আমার বড় আপার কাছে এবং পরেরদিন সে বিয়ে করতে আসবে না বলে সাফ জানিয়ে দিলো। বড় আপা তখন খুব ঠান্ডা মাথায় সবকিছু ম্যানেজ করলেন। আমাকে নিপুণের কাছে ক্ষমা চাইতে হলো তখন। বিয়ের সন্ধিক্ষণে আমি কাঁদছিলাম আর ক্ষমা চাইছিলাম। হা হা হা। আমাকে তখন জিম্মি করে ফেলেছিলো সে। পরিবারের সম্মান বাঁচাতে আমি তখন বাধ্য হয়ে ক্ষমা চেয়েছিলাম নিপুণের কাছে মিঃ ফারদিন কিন্তু বুকের ভিতরটা দাউদাউ করে জ্বলছিলো ঘৃণার আগুনে। ভালোবাসাগুলো সাপের বিষাক্ত বিষের মতো নীল হয়ে গিয়েছিলো মূহুর্তের মধ্যেই। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালায় দুলতে থাকলো আমার বিশ্বাসের ফেনীল জলরাশী। আমার দুচোখের পাতায় আঁকা ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলো রাতের আকাশের তারা খসে পড়ার মতো করে একে একে খসে পড়তে শুরু করেছিলো। হঠাৎ আবারও বিশ্বাস ভঙ্গের  নিঃসঙ্গতায় পেয়ে বসেছিলো সে রাতে আমায়। কিছুতেই আমি নিজের সাথে বোঝাপড়ায় জিততে পারছিলাম না। সে রাতে বহুবার মনে হয়েছিলো নিপুণ কে চুড়ান্তভাবে প্রত্যাখান করে ফিরে আসি নিজের অস্তিত্বের সীমারেখায়। ফিরে আসি নিজের পরিবারের ভালোবাসার ছায়ায় কিন্তু পারিনি মিঃ ফারদিন। আমি পারিনি কিছুই করতে। ওই যে রক্ষণশীল পরিবারের বেড়া দুই পায়ে পরানো ছিলো আমার। তাই কোনো আগল ভাঙতে পারিনি সেদিন। ক্ষমার বিনিময়ে পরের দিন আকদ হয়ে গিয়েছিলো আমাদের। যখন সে আমার পাশে বসে ছবি তুলছিলো, সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলো তখন আমার ভিতরটা পুড়ছিলো অন্তহীন দহনে আর তখনই সে আমার হাতটা প্রথম স্পর্শ করে। আমার জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের প্রথম ছোঁয়া কিন্তু আমার কোনো রেসপন্স ছিলো না। হ্যাঁ তার সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলাম ঠিক-ই কিন্তু ভিতরটা,,,,, ভাগ্যিস মনের ভিতরটা বোঝার কোনো যন্ত্র আবিস্কার হয়নি এখনো। চোখ মনের কথা বলতে পারে কিন্তু অন্তর পোড়ার গন্ধটাকে বুঝতে পারে না মিঃ ফারদিন। ছাই হওয়া অন্তর জুড়ে শুধুই বিষাদের জমাট কালো ছায়া তখন। রক্তের অনুগুলো পর্যন্ত বিষাদময় হয়ে উঠেছিলো। বিয়ের আনন্দটা উপভোগ করার পরিবর্তে রক্ত পোড়ার গন্ধে হৃদয় ছয়লাব হয়ে গিয়েছিলো। বাড়ি ভর্তি লোকজন কেউ- ই জানলো না নিপুণের আচরণটা। বড়আপা বিষয়টাকে কাউকে না বলে সম্পূর্ণ গোপন করে গিয়েছিলেন। আমাকেও বলা হয়েছিলো কাউকে না বলতে কারণ লাল ভাই জানার সাথে সাথেই বিয়েটা বাতিল করে দিবেন। তার আত্মমর্যাদা বোধটা অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশি প্রখর। তিনি ভীষণ রাগী এবং জেদী প্রকৃতির হলেও মনটা খুব নরম। আত্মসম্মানবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে কিছু করতে তিনি কোনো মতেই রাজি নন। আর লাল ভাই তো আমাকে নিপূণের সাথে বিয়ে দিতে কখনই রাজি ছিলেন না। তাই নিপুণ যখন বিয়ের আগের রাতে আমাকে বিয়েটা ভাঙার হুমকি দিয়েছিলো তখন সেটা যদি লাল ভাই ঘুনাক্ষরেও জানতে পারতেন তাহলে কোনো মতেই আর বিয়েটা হতে দিতেন না তিনি। এইজন্য আর কাউকে বলা হলো না কিছু-ই। কেউ-ই জানলো না আমার অন্তর পোড়ার গন্ধটাও। 

 

একটা চঞ্চল,উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত মেয়ে তার নিজের পছন্দের মানুষটাকে সারাজীবনের জন্য পেতে যাচ্ছে তার তো রীতিমতো আনন্দ উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত থাকার কথা ছিলো। ভালো লাগার আবেশে কথার খই ফোটার কথা ছিলো তার মুখে,,,,, অস্হিরতায় বুকের ভিতরটা জমে যাবার কথা, জমাট বাঁধা বরফের মতো,,,,,, অথচ তার অনুভূতিগুলো হঠাৎ করেই মরে গিয়েছিলো যেনো। কিছুতেই আমি সেই  রক্ত পোড়া মৃত কোষ গুলোকে জীবনের ছোঁয়া দিতে পারি নি আর মিঃ ফারদিন। নিপুণ যা করেছিলো আমাদের বিয়ের আগের রাতে সেটা করার আগে তার একবার ভাবা উচিত ছিলো, এই মূহুর্তে এই কথাটা বললে শুভ্রার মানষিক অবস্থাটা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে! কতটা কষ্ট শুভ্রা পেতে পারে। কতটা অপমানিত বোধ সে করতে পারে। এটা তার মনের ভিতরটাকে কিভাবে বদলে দিতে পারে। নিপুণ পুরুষ মানুষ তাই নারীর মন বোঝার দায় তার কেনো থাকবে?তার যখন যা ইচ্ছে হবে তখন সে তাই ই করবে।

 

অথচ সেদিন যদি আমি বারবার নিপুণকে ক্ষমা না করতাম তাহলে আমাকে পাবার স্বপ্নটা তার কাছে  দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে যেতো সারাটা জীবন ধরে মিঃ ফারদিন। আমি বোকা তাই বারবার, বহুবার তাকে ক্ষমা করেছিলাম। তাই আজ জীবন আমাকে আর ক্ষমা করেনি। জীবন নিজ দায়িত্বে আমাদেরকে আলাদা করে দিয়েছে। আমি হয়তো বেঁচে গিয়েছি কিন্তু আমার সন্তানের জন্য অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেলো...। 


ক্যাটেগরিঃ Youth, Young Icons,